বগুড়া সংবাদ : মোয়াজ্জিম হোসেন মারা গেছে প্রায় ১ বছর আগে। কিন্তু মৃত্যুর পর মাঝে মাঝে জীবিত হয় সরকারি বরাদ্দকৃত চাল নিতে। আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে একাধিক বার উঠিয়ে নেন ৩০ কেজি করে চাল। কেউ বা জানেই না তার নামে কার্ড রয়েছে। আবার পুরুষের নামের পাশে আছে নারীর ছবি। প্রবাসী ব্যাক্তির নামেও আছে কার্ড। একই সাথে রয়েছে জীবিতদের কার্ডের চাল আত্মসাতের ঘটনা। এই অসম্ভব কাজগুলো সম্ভব হয়েছে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার চাঁপাপুর ইউনিয়নে। আর সব সম্ভবের হোতা ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ডিলার।
চাঁপাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জানান, প্রায় এক বছর আগে মারা গেছে মোয়াজ্জিম হোসেন। এমনকি আমি নিজেও করেছি জানাজা। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির ৩০ কেজি চাল বিতরণের সময় মোয়াজ্জেমের মৃত্যুর পরও একাধিক বার তার কার্ড দিয়ে উঠেছে চাল।
এই কর্মসূচির ডিলার মাজেদ মোয়াজ্জেমের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে বলেন, তার মৃত্যুর তথ্যটি চেয়ারম্যান ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কে জানানো হয়েছে। নাম বাদ না যাওয়াই তার নামে তার কোনো এক আত্মীয় চাল উঠিয়ে নেয়। তবে ডিলারের কথার সাথে মিল পাওয়া যায় না সরজমিনে গিয়ে। চাল বিতরণের সময় দেখা যায় মৃত মোয়াজ্জেম হোসেনের চাল তুলছে ডিলারের লোকজন এমনকি আঙ্গুলের ছাপও দিচ্ছে তারা।
একই ইউনিয়নের বেজার গ্রামের গৃহবধু লাভলী আক্তার। খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির কার্ড রয়েছে লাভলী আক্তারের নামেও। তবে লাভলী আক্তার জানে না তার নামে রয়েছে কার্ড। খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির তালিকায় লাভলী আক্তারের নাম ও ছবি দেখে তার সাথে কথা বলতে যাওয়া হয় তার বাড়িতে। তবে তালিকায় লাভলী আক্তারের যে ছবি দেওয়া আছে তার সাথে বাস্তবের লাভলী আক্তারের মিল পাওয়া যায় না। লাভলী আক্তারের জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বার, বাবার নাম ঠিক থাকলেও ছবিটি তার শ্বাশুড়ির। এমনকি তিনি গৃহীনি হলেও তার পেশা দেওয়া আছে দিন মজুর। এ সব বিষয়ে লাভলী আক্তার ও তার শ্বাশুড়ি বলেন, তারা কখনো কার্ডের জন্য মেম্বার বা চেয়ারম্যানকে জানান নাই। তাদের নামে যে কার্ড আছে সেটিও তারা জানেন না।
চাঁপাপুর ইউনিয়নের বেজার গ্রামের ইউপি সদস্য ইসমাইল হোসেন বলেন, লাভলী আক্তারের ভাইয়ের পরিচয়ে এক ব্যাক্তি কাগজ নিয়ে এসেছিল। তাই তার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। লাভলী আক্তার বা তার শ্বাশুড়ি কখনো তার কাছে কার্ডের জন্য আসে নাই বলেও জানান এই জনপ্রতিনিধি। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় লাভলী আক্তারের কার্ড দিয়ে একাধিক বার চাল উঠানো হয়েছে। যে চাল উঠিয়েছেন ডিলার নিজেই।
ওই ইউনিয়নের ৩নং ওর্য়াডের ভেনল্যা গ্রামের বাসিন্দা শাহিদুল ইসলাম। তার নামেও রয়েছে একটি কার্ড। তবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ডে শাহিদুল ইসলামের ছবির পরিবর্তে রয়েছে এক মহিলার ছবি। আর এ বিষয় নিয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হয়নি শাহিদুল ইসলাম বা তার পরিবার। তবে একটি সূত্রে জানা যায়, শাহিদুল ইসলাম প্রবাসে থাকেন এবং তালিকার ছবিটি তার স্ত্রীর।
চাঁপাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের নাতী সোহাগ পারভেজ। ইউনিয়ন পরিষদে চাল বিতরণের দায়িত্বে দেখা যায় তাকে। তবে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির তালিকায় রয়েছে সোহাগ পারভেজের নামও। নাতীর নামে কার্ড রয়েছে তা জানেন না বলে জানায় চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ইউপি সদস্যদের দায়িত্ব থাকে কারা কারা কার্ড পাওয়ার যোগ্য তাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহের। মেম্বার আমার নাতীতে কার্ড দেওয়ার যোগ্য মনে করেছে তাই হয়তো কার্ড দিয়েছে। এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই।
সম্প্রতি চাল বিতরণ করা হয় এই ইউনিয়ন পরিষদে। সরজমিনে ইউনিয়নের বিহিগ্রাম এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ডিলারের নিয়োগকৃত লোকেরা চালের পরিবর্তে টাকা বিতরণ করছে। আবার কয়েক জন চাল নিলেও সেই চাল ডিলারের লোকদের কাছেই বিক্রি করে দিচ্ছে। চাল বিতরণের সময় ট্যাগ অফিসার থাকার কথা থাকলেও সেখানে কোনো ট্যাগ অফিসারকে দেখা যায় নাই।
ডিলার বিরুদ্ধের অভিযোগগুলো নিয়ে ডিলার মাজেদ বলেন, যাদের কার্ড আছে আমি তাদের বা তাদের কার্ড কেউ নিয়ে আসলে চাল দেই। চালের বদলে টাকা দেওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, কাউকে টাকা দেওয়া হয় না চালই দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে চাঁপাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেন, ইউপি সদস্যরা যাদের নাম দিয়েছে তাদের নামেই কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। ডিলার চাল দিচ্ছে নাকি টাকা দিচ্ছে এই সব খতিয়ে দেখবো। আর নাম একজনের ছবি অন্য জনের এটা হতে পারে না। কার্ড করার সময় সকলকে আসতে হয়েছিল ইউনিয়ন পরিষদে।
এ ব্যাপারে আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গোলাম রব্বানী বলেন, আপনাদের মাধ্যমে বিষয়গুলো জানতে পারলাম। আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো।