মাংসের বালাচাও এর সুনাম এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে, চাকুরি ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস

বগুড়া সংবাদ : “পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” আজকের বাংলাদেশে এই সত্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারীর অদম্য অগ্রযাত্রার মাধ্যমে। ঘরে বাইরে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা অনলাইন উদ্যোক্তা হিসেবে—নারীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে। তাদের সৃজনশীলতা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম বদলে দিচ্ছে সমাজ ও অর্থনীতির চিত্র। এই নারী শক্তির জাগরণের এক উজ্জ্বল উদাহরণ বগুড়ার সফল উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস, যিনি জীবনসংগ্রামের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন অন্য নারীদের জন্য।

১৯৭৭ সালের ২৫ জুলাই বগুড়ার সারিয়াকান্দির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মরহুম মোঃ খৈবর রহমান তরফদার ও খালেদা পারভিনের ঘরে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী ও পরিশ্রমী। নবাব হাবিবুল্লাহ আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে এসএসসি, বগুড়া কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পাস করে তিনি উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স এবং ২০০৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনের শুরুটা হয় এনজিও খাতে চাকরির মাধ্যমে। কিন্তু মনের ভেতরে সবসময়ই ছিল নিজে কিছু করার আকাঙ্ক্ষা। সেই চিন্তা থেকে লাখো টাকার বেতনের চাকরি ছেড়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, চাকরির সুবাদে একসময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে থাকাকালে ‘বালাচাও’ নামে মশলা মেশানো চিংড়ি মাছ বিক্রি হতে দেখেছিলাম। বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ভাবলাম, মাংস দিয়েও এমন কিছু তৈরি করা যায় না? সেই চিন্তা থেকে দৃঢ় মনোবল, সৃজনশীল চিন্তা আর সাহসকে সঙ্গী করে তিনি শুরু করেন নিজস্ব উদ্যোগে মাংসের বালাচাও তৈরি। নিজ হাতে মাংস, পেঁয়াজ, রসুন ও মশলা মিশিয়ে তৈরি করেন বালাচাও—এক ধরনের রেডি-টু-ইট খাবার, যা ঘরোয়া স্বাদে ও বিশুদ্ধ উপকরণে তৈরি। ফেসবুকে পেজ খুলে বিক্রি শুরু করেন তিনি। বালাচাও এর দাম জানতে চেয়ে ইনবক্সে মেসেজ আসা শুরু করলো তখন আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। এই ভাবে আমার বালাচাও বিক্রি শুরু হয়ে গেল এবং প্রতিনিয়ত অনলাইনে অর্ডার পেতে শুরু করলাম। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সাইজের স্বাস্থ্য সম্মত ফুড গ্রেডেড প্লাষ্টিক কৌটায় বালাচাও বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। বালাচাও ভাত, খিচুরি, মুড়ির সাথে বা এমনিতেও খাওয়া যায়। খেতে খুব সু-স্বাদু এবং পুষ্টিকর।

শুরুর দিকে বাজার সম্প্রসারণ ও ব্যবসা পরিচালনায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। তখন  গ্রাম উন্নয়ন কর্ম (গাক) -এর সহায়তায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে ব্র্যান্ডিং, মোড়কীকরণ ও ই–কমার্স বিপণন সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা তার ব্যবসায় নতুন গতি আনে। ব্যবসায় সফলতা ও পূর্ণতা দানে গাক এর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না করলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। বর্তমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, ফলে বহু শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি বদলাতে হলে উদ্যোগভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্ব-উদ্যোগে কাজ শুরু করতে হবে। আমার স্বপ্ন—একদিন আমার মাংসের ‘বালাচাও’ বড় কারখানায় রূপ নেবে, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে এবং বহু বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। অল্প পুঁজিতে শুরু করা এই উদ্যোগ আজ তাকে এনে দিয়েছে পরিচিতি, সম্মান ও আত্মনির্ভরতার অনন্য উদাহরণ।

নানা প্রতিকূলতা ও সামাজিক বাঁধা পেরিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলা সফল নারী উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌসের এই পথচলা যেন অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ক্যাপশন: সফল নারী উদ্যোক্তা বগুড়ার জান্নাতুল ফেরদৌস।

Check Also

দুপচাঁচিয়া বিএনপির সাংগঠনিক ও মতবিনিময় সভা

বগুড়া সংবাদ : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দুপচাঁচিয়া পৌর শাখার উদ্যোগে সাংগঠনিক আলোচনা ও মতবিনিময় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *