
বগুড়া সংবাদ : চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে চলন্ত ট্রেনের দরজা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পরে প্লাটফর্মে আসতেই তাকে ফেলে দেওয়া হলে তিনি চলে যান ট্রেনের নিচে। কিছু লোক ট্রেনের মধ্যে মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে মব সৃষ্টি করে। তবে এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা।
রোববার (১৮ মে) দুপুরে বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার নশরৎপুর স্টেশনে বগুড়া থেকে সান্তাহার অভিমুখী একটি কমিউটার ট্রেনে এই ঘটনা ঘটে। ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম মতিউর রহমান (৪০)। তার বাড়ি নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পারইল গ্রামে। মতিউর রহমানের বাবা হবিবর রহমান বিগত জাতীয় পার্টির আমলে পারইল ইউনিয়নের দুইবার চেয়ারম্যান ছিলেন।
মতিউর রহমানের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে মতিউর রহমান পেশায় একজন অটোরিকশা চালক ছিলেন। দুই বছর আগে দূতাবাস এবং এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কাজ করেন। ২০দিন আগে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার তালশান গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের ছেলে সজীব হোসেনকে সাড়ে ৪লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন। সৌদি আরবে গিয়ে সজীবের বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় তার পরিবারের সদস্যরা ৭-৮ দিন আগে মতিউরের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চায়। এ নিয়ে সেখানে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে বগুড়া থেকে ট্রেনে মতিউরকে একা পেয়ে সজীবের ছোট ভাই রাকিব এবং সজীবের শ্যালকরা মিলে মোবাইল চুরির মগ সৃষ্টি করেন এবং ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তার কাছে থেকে ৫০হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেছেন মতিউরের পরিবার।
মতিউর রহমানের ছেলে আহসান হাবিব মুঠোফোনে বলেন, আমার বাবা পেশায় একজন অটোরিকশা চালক ছিলেন। গত দেড় বছর থেকে সৌদি আরবের অ্যাম্বাসির মাধ্যমে লোক পাঠানোর কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত ৩-৪ জনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। তারা সেদেশে ভালো আছে। গত ১৫ দিন আগে আমার বাবা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার তালশন গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের ছেলে সজিব হোসেনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। সৌদি আরবে পাঠানো বাবদ তার কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে যেয়ে বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় সজিব তার বাবাকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে গত ৭-৮ দিন আগে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার জের ধরে বগুড়া থেকে ট্রেনে বাড়িতে ফেরার পথে সজিবের ছোট ভাই রাকিব এবং সজীবের শ্যালকরা আমার বাবাকে মোবাইল চোর বলে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বাবা খুব কষ্ট করে প্রায় ৪-৫ মিনিট ট্রেনের সঙ্গে ঝুলে ছিল। বাবার কাছে ব্যবসায়িক কাজের ৫০হাজার টাকা ছিল সেটিও তারা কেড়ে নেয়। এক পর্যায়ে ট্রেনটি আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর স্টেশনে এলে সেখানকার প্লাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আমার বাবা ট্রেনের নিচে পড়ে যায়। ট্রেনের নিচে পড়লেও বাবা কোনরকম প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু সেখানকার উৎসুক জনতা বাবাকে মোবাইল চোর এবং ছিনতাইকারী ভেবে বেধরক মারধর করতে থাকেন।
আহসান হাবিব আরও বলেন, বাবাকে কোনো রকম সেখান থেকে উদ্ধার করে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। এ ঘটনায় আদমদীঘি থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে তারা আমার অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং আদমদীঘি থানার ওসি আমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেন। তারা আমাকে বলেন এটি রেলওয়ের বিষয়, এই অভিযোগ সান্তাহার রেলওয়ে থানায় গিয়ে করুন। আদমদিঘী থানা পুলিশের কথা শুনে সান্তাহার রেলওয়ে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে তারা বলেন, আপনার বাবা জীবিত রয়েছে। মারা গেলে মামলা নেওয়া যেত। আমরা এখন কোথায় গিয়ে অভিযোগ করব? এ ঘটনার পর থেকে মানুষের সামনে যেতে পারছি না। আমার বাবা তো ছিনতাইকারী না। সে বৈধ পথে ব্যবসা করে আসছিলেন। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।
বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার কুশম্বী গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান বলেন, মতিউরকে দীর্ঘদিন থেকে চিনি। তার মাধ্যমে আমার দুই আত্মীয়কে বিদেশে পাঠিয়েছি। একজন সৌদি আরবে এবং আরেকজন মালয়েশিয়াতে আছে। এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। মতিউরের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে কখনো কারো ঝামেলা হতে দেখিনি।
অভিযোগের বিষয়ে সজীবের বাবা মোহাম্মদ হেলাল বলেন, ১ মাস আগে বড় ছেলে সজীবকে মতিউরের মাধ্যমে চার লাখ ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত মতিউর আমার ছেলেকে কোনো কাজ দিতে পারেনি। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি। সে আমার সঙ্গে দেখা না করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। গত ৭ থেকে ৮ দিন আগে তার বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম ছেলের বিষয়ে জানতে, তবে সেখানে কোনো প্রকার ঝামেলা হয়নি। মতিউরকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে ছেলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বগুড়া থেকে আসার সময় সজীবের শ্যালোকরা ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে মতিউরকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে রাকিব সেখানে কিছুই করেনি। ট্রেনে কি হয়েছে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
অভিযোগের বিষয়ে বগুড়া আদমদিঘী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি রেলওয়ে পুলিশের বিষয় তাই আমরা কোনো অভিযোগ নেইনি।
সান্তাহার রেলওয়ে থানা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি জিআরপি) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, তারা প্রথমে আদমদিঘী থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল। সেখানে তাদেরকে জিআরপিতে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। তখন তারা আমার থানায় এসেছিল। আসার পরে তাদেরকে নাকি আবার আদমদীঘি থানা থেকে ফোন করা হয় তখন তারা আবারও আদমদীঘি থানায় অভিযোগ জানাতে চলে যায়। পরে তারা আর আমার থানায় আসেনি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা সবসময় অভিযোগ এবং তদন্ত সাপেক্ষে মামলা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।