বগুড়া সংবাদ :কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বগুড়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ওই মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী—এমনকি আওয়ামী লীগের একজন নেতা ও দুই সমর্থককেও আসামি করা হয়েছে।
কোটা আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত সদর থানায় ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনির খান এন্টার প্রাইজ নামে বাণিজ্যিক অফিসে হামলা ও ভাঙ্চুরের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। সুলতান মাহমুদ খান রনি নিজেই বাদি হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখসহ ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
মামলায় রনি উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই কোটা আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন চলাকালে শহরের সাতমাথায় তার অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙ্চুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে হামলাকারীরা। এতে ৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দায়ের করা ১৩টি মামলায় ১০৮৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার প্রায় সব আসামিই বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মী। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোট ৮২ জনকে। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা পলাতক আসামিদের ধরতে মেসে মেসে ও বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
র্যাব সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রাতেও র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে নাশকতা মামলায় আরও ২জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো শহরের সেউজগাড়ী পালপাড়া এলাকার রবিউল ইসলাম রাশেদ (২৫) ও চকসুত্রাপুর হাড্ডিপট্টি এলাকার ইমরান (২৫)।
বগুড়া সদর থানা–পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৬ জুলাই বগুড়া শহরের সাতমাথায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ওই সময় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহদপ্তর সম্পাদক আসাদুজ্জামান রাজা বাদী হয়ে গত সোমবার বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা করেন। এতে জেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশাসহ ৮৭ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগরকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এতে আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা, সদ্য পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া ছাত্রলীগ নেতা, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, দুটি বেসরকারি পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ, পরিচালকসহ অনেককেই।
মামলায় ৬৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে বগুড়া পৌর আওয়ামী লীগের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও শহর যুবলীগের রহমান নগর আঞ্চলিক কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুল হক কাজলকে। তিনি বগুড়া পৌরসভার ১০ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফুর রহমানের ভাই। তিনি শহরের বিআরটিসি শপিং কমপ্লেক্সের সভাপতি। ওই মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন আকরামকেও আসামি করা হয়েছে।
ওই মামলার আরেক আসামি আবু বক্কর সিদ্দিক বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সদস্য বলে জানিয়েছেন, ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল বারী।
ওই মামলায় ১২ নম্বর আসামি জাকি তাজওয়ার সমুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
তিনি বগুড়া শহরের সাতমাথায় জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত ১৬ জুলাই রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে আরো রয়েছেন জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শাওন পাল। জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পোড়ানো মামলার ৬৩ নম্বর আসামি সবুর শাহ লোটাস বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুরন্ত সংবাদ–এর সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি বগুড়া প্রেসক্লাবের সদস্য এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বগুড়া ব্যুরোপ্রধান ছিলেন। ৬৪ নম্বর আসামি প্রকৌশলী শাহাবুদ্দিন সৈকত বগুড়ার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (বিআইআইটি) এবং বিট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলার এজাহারে থাকা ৪৮ নম্বর আসামি জলেশ্বরীতলার ফাইম আবীর এ বছর বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। মামলায় আসামি করার পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছে এই কিশোর।
মামলার এজাহার সংগ্রহের পর খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, মামলার এজাহারে থাকা ৮৭ নম্বর আসামি লায়লাতুন নাজিম বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা উম্মে ফাতেমা ওরফে লিসার মেয়ে। লায়লাতুন নাজিম শৈশব থেকে পড়ালেখা করেছেন সেনাবাহিনী পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বগুড়ার মিলেনিয়াম স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১ সালে এসএসসি ও ২০২৩ সালে এইচএসসি পাসের পর এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীনুজ্জামান বলেন, এ মামলার অন্যতম আসামি বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন রয়েছেন তিনি। ওই মামলার এজাহারে ৩ ও ৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে বগুড়া পৌরসভার এরশাদুল বারী এরশাদ ও পরিমল চন্দ্র দাসকে। এ ছাড়া মামলার ২৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে নারী কাউন্সিলর শিরিন আকতারকে।
অন্যদিকে সিপার আল বখতিয়ারকে কোটা আন্দোলনের সহিংসতার সময় বগুড়ায় বিচারকদের বাসায় হামলার ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, বখতিয়ারের নেতৃত্বে ও নির্দেশে ২৫ আসামিসহ অজ্ঞাতনামা অনেকেই ১৮ জুলাই বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড় এলাকায় সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল ছোড়েন। পরে তাঁরা জেলার বিচারকদের বাসভবনে হামলা করে বেশ কয়েকটি যানবাহন পুড়িয়ে দেন।
১৯ জুলাই বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের আমতলা মোড় এলাকায় কোটা আন্দোলনের সমর্থনে সড়ক অবরোধ করা হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে সিয়াম (১৬) নামের পথচারী এক কিশোর নিহত হয়। এ ঘটনায় ২১ জুলাই সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির আল আহসান বাদী হয়ে বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন। এতেও আসামি (২ নম্বর) করা হয়েছে জামায়াত–সমর্থিত কাউন্সিলর এরশাদুল বারীকে।
১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে শহরের থানা মোড় এলাকায় সহিংসতা হয়। সেখানে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে বগুড়া সদর থানার এসআই নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে ১৯ জুলাই বিএনপি-জামায়াতের ৩৩ নেতা–কর্মীকে আসামি করে সদর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার এজাহারে ৭ নম্বর আসামি করা হয় পরিমল চন্দ্র দাসকে। একই দিন শহরের কলোনি এলাকায় সরকারি পলেটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় বগুড়া শহরের বনানী ফাঁড়ির এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে এনামুল হক সুমনকে।
১৮ জুলাই শহরের সাতমাথায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় বগুড়া সদর থানার এসআই বেদার উদ্দিন বাদী হয়ে ১৩ জনকে আসামি করে বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় ৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে রুস্তম আলীকে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, নাশকতা, সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা সংক্রান্ত বিষয়ে মামলাগুলো দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি মামলার বাদি পুলিশ। আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ, এসি-ল্যাল্ডের অফিস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ, পোস্ট অফিসে ভাঙচুর ও রেলওয়েতে নাশকতার ঘটনায় বাকি চারটি মামলা স্ব স্ব দপ্তর থেকে করা হয়েছে।