বগুড়া সংবাদ : আল্লাহ তাআলা যাকে যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। এর হেকমত, উদ্দেশ্য ও রহস্য তিনিই ভালো জানেন। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব তাঁরই, তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন’ (সূরা শূরা: ৪৯)। অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, তিনিই মহান সত্ত্বা ; মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা আলে ইমরান: ৬)
আল্লাহ তাআলা কাউকে পুরুষ, কাউকে নারী, আবার কাউকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে। যেমন লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। কিন্তু তারাও সৃষ্টির সেরা জীব অর্থাৎ আশরাফুল মাখলুকাতের সদস্য। আর মহান আল্লাহর কাছে বান্দার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।
পবিত্র কোরআনে তিনি ঘোষণা করেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি তাকওয়াসম্পন্ন…।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করেন না, বরং তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। (সহিহ মুসলিম: ৬৭০৮)
ইসলামের দৃষ্টিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মানুষ হিসেবে যথাযথ সম্মান ও অধিকার পাওয়ার অধিকারী। ত্রুটিপূর্ণ দৈহিক গঠনের জন্য সহানুভূতিরও দাবিদার। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষের জন্ম ও দৈহিক অবয়ব সম্পূর্ণ আল্লাহর দান। আল্লাহ যাকে যেভাবে খুশি সৃষ্টি করেন। দৈহিক পূর্ণতা ও অপূর্ণতা তার ইচ্ছাধীন।
ইসলাম হিজড়াদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে তাদের উত্তরাধিকার সম্পদ বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী তারা মা-বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবে। যে হিজড়ার মধ্যে নারী বা পুরুষ কোনো একটি প্রকৃতি প্রবল, সে নারী বা পুরুষের হিসেবে উত্তরাধিকার সম্পদ পাবে। আর যার প্রকৃতি সহজে নির্ধারণ করা যায় না তার ব্যাপারে চিকিৎসকদের মতামত নেওয়া হবে। (সুনানে বায়হাকি: ১২৯৪)
মূলত ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানব মর্যাদার মানদণ্ড কোনো বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, সুস্থতা, সৌন্দর্য আর নারী-পুরুষের তারতম্যের ভিত্তিতে নিরূপণ হয় না। ইসলাম সক্ষম ব্যক্তিকে অক্ষম ব্যক্তির স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে দায়িত্ব প্রদান করেছে। এতে রয়েছে বান্দার ইহকাল এবং পরকালীন সফলতা ও মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পরিচয়
বিশেষ লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ, যার লৈঙ্গিক গঠন অনুপযোগী, বিকলাঙ্গ অথবা উভয়লিঙ্গ বা খোঁজা (না পুরুষ না নারী)। শরিয়তের পরিভাষায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তারাই, যার পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়টি রয়েছে অথবা কোনটিই নেই, শুধু প্রস্রাবের জন্য একটিমাত্র ছিদ্রপথ রয়েছে। সংক্ষেপে একইসঙ্গে স্ত্রীচিহ্ন এবং পুংচিহ্নযুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত মানুষই হলো লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। (কামুসুল ফিকহ: ৩/৩৭৭)
তৃতীয় লিঙ্গের শ্রেণিবিন্যাস
(১) পুরুষ শ্রেণি। যাদের দাড়ি গোঁফ গজায়, সহবাসের সক্ষমতা এবং স্বপ্নদোষ জাতীয় নরচিহ্ন প্রকাশিত হয় তারা পুরুষ শ্রেণিভুক্ত।
(২) নারী শ্রেণি। যাদের স্তন, ঋতুস্রাব, সহবাসের উপযোগিতা, গর্ভ সঞ্চার হওয়া ইত্যাদি নারীচিহ্ন প্রকাশিত হয় তারা নারী শ্রেণিভুক্ত।
(৩) তৃতীয় শ্রেণি। যার মাঝে নারী-পুরুষের কোনো নিদর্শনই পরিলক্ষিত হয় না অথবা উভয় ধরণের নিদর্শনই সমানভাবে পরিলক্ষিত হয় তারা তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। শরিয়তের পরিভাষায় তাদেরকে ‘খুনসায়ে মুশকিলা’ তথা জটিল হিজড়া বা প্রকৃত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়।
ফুকাহায়ে কেরাম তাদের রচনাবলীতে ‘বাবুল খুনসা’ (হিজড়া অধ্যায়) শিরোনামে স্বতন্ত্রভাবে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তিন ধরনের হয়ে থাকে। এদের মধ্যে পুরুষ শ্রেণি ও নারী শ্রেণির বিধান পুরুষ ও নারীর মতোই। আর তৃতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে দীনের সাধারণ বিষয়গুলোর বাইরের বিধানগুলোতে নারী-পুরুষভেদে পার্থক্য আছে। বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো।
প্রকৃত লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের বিস্তারিত শরয়ি বিধান
আজান-ইকামত: ফুকাহায়ে কেরামের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই যে, এ শ্রেণির লিঙ্গ প্রতিবন্ধীর আজান ও ইকামত দেওয়া সহিহ নয়। (সুনানে বায়হাকি: ১/৪০৮; আলমুগনি: ১/৫৩০; আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/২২)
ইমামত: এমন লিঙ্গের মানুষের জন্য কোনো পুরুষ বা তার মতো অন্য কারো ইমামতি করা জায়েজ নেই। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/২৫)
নামাজে দাঁড়ানো এবং ওড়না পরিধান করার বিধান: জামাআতে নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে এ শ্রেণিটি পুরুষের পেছনের কাতারে দাঁড়াবে এবং নামাজে তারা ওড়না ব্যবহার করবে। আর নামাজে বসার ক্ষেত্রে নারীদের মতো বসবে। (আলবাহরুর রায়েক: ৯/৩৫, ৩৬, কামুসুল ফিকহ: ৩/৩৭৯, কিতাবুল আসল লি ইমাম মুহাম্মাদ: ৯/৩২৪)
হজ-ইহরাম সংক্রান্ত বিধান: হজের সকল বিধি-বিধান নারীদের মতো করে পালন করবে এবং মাহরাম কোনো পুরুষ ছাড়া তাদের হজ করার অনুমতি নেই। (ফাতহুল কাদির: ১০/৫৫৩, আলবাহরুর রায়েক: ৯/৩৩৬)
অলংকার পরার বিধান: তাদের জন্য সব ধরনের অলঙ্কার পরিধান করা মাকরুহ। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/৩০, ইনায়া আলা ফাতহিল কাদির: ১০/৫৫২, বাদায়িউস সানায়ে: ৭/৩২৯)
খতনার বিধান: কোনো পুরুষের মাধ্যমে হোক কিংবা নারীর মাধ্যমে, নাবালেগ অবস্থায়ই তাকে খতনা করিয়ে দিতে হবে। আর যদি সে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর খতনা করতে চায়, তাহলে খতনা করাতে পারে এমন কোনো নারীর সঙ্গে তাকে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হবে। নতুবা সে খতনাবিহীন জীবন যাপন করবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পুরুষের মাধ্যমে হোক কিংবা নারীর মাধ্যমে হোক সর্বাবস্থায় তার জন্য খতনা করানো মাকরুহ। (ফতোয়ায়ে শামি: ১০/৪৪৮, কামুসুল ফিকহ: ৩/৩৭৮, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/৩০)
সতর ও পর্দা বিধান: এই শ্রেণির মানুষের সতরের বিধান নারীদের সতরের মতো। তাছাড়া তারা কোনো পুরুষ বা নারীর সামনে ইস্তিঞ্জা এবং গোসলের জন্য সতর খুলবে না। অর্থাৎ এক কাপড় পরিহিত অবস্থায় থাকবে না এবং গাইরে মাহরাম কোনো নারী-পুরুষ তার সঙ্গে নির্জনতা অবলম্বন করবে না। এমনকি শুধু মাহরাম মহিলাদের সঙ্গে সফর করাও মাকরুহ। (আলবাহরুর রায়েক: ৯/৩৩৬, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/২৬, রদ্দুল মুখতার: ১০/৪৪৯)
স্তন্যপান ও বৈবাহিক নিষিদ্ধতা: এই শ্রেণির কারো স্তনে যদি দুধ আসে তবে তা কাউকে পান করানোর দ্বারা রাজাআত তথা বৈবাহিক নিষিদ্ধতা সাব্যস্ত হবে না। কেননা সে নারী (দুধমা) হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট নয়; যা রাজাআত সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বশর্ত। তবে যদি কোনো পুরুষ বা নারী তাকে উত্তেজনার সাথে চুমু দেয় তাহলে এর দ্বারা বৈবাহিক নিষিদ্ধতা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ চুম্বনকারী পুরুষের জন্য তার মা এবং নারীর জন্য তার বাবাকে বিবাহ করা হারাম হয়ে যাবে। (ফতোয়ায়ে শামি: ১০/৪৪৯, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ: ২০/২৭)
বিয়ে-শাদি: এ শ্রেণির মানুষকে যদি কোনো পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় আর উক্ত পুরুষের জন্য তার সঙ্গে সহবাস করা সম্ভব হয়, তাহলে বিয়ে বহাল থাকবে। একইভাবে সে যদি কোনো নারীকে বিয়ে করে এবং সে নারীর সঙ্গে সহবাস করতে সক্ষম হয়, তাহলেও উক্ত বিয়ে বহাল থাকবে। আর যদি সে সহবাসে সক্ষম না হয় এবং স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হয়, তাহলে আদালত স্বামীকে এক বছর সময় দিবে। উক্ত সময়ের মধ্যেও যদি সে সহবাসে সক্ষম না হয় তাহলে আদালত তাদের মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ করে দেবে। (কিতাবুল আসল লি ইমাম মুহাম্মাদ: ৯/৩২৩, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/২৭)
বিচার-ফয়সালা এবং সাক্ষ্যদান: এ শ্রেণির মানুষ সাক্ষ্যদান এবং বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রেও নারীদের আওতাভুক্ত। একজন পুরুষ এবং একজন নারীর সঙ্গে তার সাক্ষ্য একজন নারীর মতোই গণ্য হবে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/২৮)
স্বীকারোক্তি গ্রহণ: এরা যদি নিজের ব্যাপারে কোনো কিছুর স্বীকারোক্তি প্রদান করে, যার দরুন তার উত্তরাধিকার অথবা দিয়ত তথা রক্তপণ হ্রাস পায় তাহলে তা গ্রহণ করা হবে। আর যদি এমন দাবি করে যার দ্বারা এগুলো বৃদ্ধি পায় তবে তা গ্রহণ করা হবে না। কারণ এ ব্যাপারে সে অন্যকে দোষারোপকারী। বিধায় অন্যের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণ করা হবে না। আর ইবাদত এবং অন্যান্য বিষয়ে তার কথা গ্রহণ করা করা হবে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/২৮; আলমুগনি: ৬/৭৭, ৪/৪৬১, ৪৬২)
উত্তরাধিকার বিধান: উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের প্রাপ্ত অংশের মধ্য হতে কম অংশ যেটা হবে তাকে তা-ই দেওয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো মৃত ব্যক্তি এক ছেলে, এক মেয়ে এবং একজন জটিল তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে রেখে মারা যায়, তাহলে তাকে মেয়ের সমপরিমাণ অংশ দেয়া হবে। তদ্রূপ মৃত ব্যক্তি যদি এক ছেলে এবং এক তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে রেখে মারা যায় তাহলে ছেলে পাবে দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ আর সে পাবে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ। (ফতোয়ায়ে শামি: ১০/৪৫০, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ: ২০/৩২, আররাজি শরহে সিরাজি; পৃষ্ঠা-৯৪)
গোসল ও কাফন-দাফন: এ ধরনের মানুষের ইন্তেকালের পর কোনো নারী-পুরুষ তাদেরকে গোসল দেবে না; বরং তায়াম্মুম করিয়ে দেবে। এক্ষেত্রে যে তায়াম্মুম করাবে সে যদি তার মাহরাম না হয় তাহলে হাতে কোনো কাপড় পেঁচিয়ে নেবে। একজন মুসলিম হিসেবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার জানাজার নামাজ পড়া হবে এবং তাকে নারীদের মতো পাঁচ কাপড়ে কাফন পরানো হবে। কেননা সে যদি নারীদের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো সুন্নতসম্মত পন্থায় কাফন পরানো হলো। আর যদি পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই। কারণ পুরুষ তার জীবদ্দশায় তিনের অধিক কাপড়ও পরিধান করে।
দাফনের সময় মাহরাম ব্যক্তিই তাকে কবরে নামাবে এবং চাদর ইত্যাদি দ্বারা তার কবরকে ঢেকে নিবে, এটি মোস্তাহাব। (ফতোয়ায়ে শামি: ১০/৪৫০, আলবাহরুর রায়েক: ৭/৩৩৭, কিতাবুল আসল লি ইমাম মুহাম্মাদ: ৯/৩২৩, কামুসুল ফিকহ: ৩/৩৭৯)
সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সকল অধিকার আদায়ের প্রতি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সাধারণের মাঝে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সঠিক অবস্থান তুলে ধরা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সেই চেতনা এবং সঠিক বোধ দান করুন। আমিন।