বগুড়া সংবাদ : বগুড়ার কাহালু উপজেলার ৫ গ্রামের মানুষের তৈরি তালপাখা চাহিদা সব সময়। গত ৫০ বছর ধরে এ পাখাশিল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন এ গ্রামগুলোর মানুষ। পাখা তৈরির জন্য এই গ্রামগুলো এখন ‘পাখার গ্রাম’ হিসেবেও পরিচিত। দেশের বিভিন্ন জেলার হাতপাখার চাহিদার সিংহভাগ জোগান দেয় এই কাহালু। এখানকার হাতপাখার আলাদা কদর রয়েছে দেশজুড়ে। গরম পড়তে শুরু করেছে। তা যত বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাহালুর পাখাশিল্পীরাও পার করছেন মহাব্যস্ত সময়। তবে, পাখাশিল্পীরা পেশা হারানোর শঙ্কায় আছেন। বৈদ্যুতিক ফ্যান ও প্লাস্টিকের হাতপাখার কারণে
তালপাখার কদর আগের চেয়ে কমেছে। এর মধ্যে অনেকে পেশাও বদলেছেন। প্রবীণ কারিগর আমজাদ হোসেন তাই বলছিলেন, ‘কারিন্টের পাঙ্খার ভিড়ে হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে এই পেশা টিকবি কি না, তা লিয়ে শঙ্কাত আচি।’ সরেজমিন দেখা যায়, পাইকড় ইউনিয়নের অড়োলা, আতালপাড়া, যোগীরভবন, কর্ণিপাড়া গ্রামের নারী-পুরুষ ভীষণ ব্যস্ত। সকাল থেকে ঘরের অঙিনায় বসে সবাই তৈরি করছেন হাতপাখা। কেউ তালপাতা চিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ হাতপাখা তৈরি করছেন, আবার কেউ তৈরি করা হাতপাখায় বেত দিয়ে চাকা বাঁধছেন। আবার কেউ তালপাতায় রং দিচ্ছেন। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। কিছু কিছু পরিবারের কিশোর-কিশোরীরা তাদের কাজে সহযোগিতা করছেন। মূলত বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও চৈত্র মাসে যখন গরম বেড়ে যায়, তখন তাল পাখার চাহিদাও বাড়তে থাকে। এখানকার পাখা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির জন্য যায়।
পাখা কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তালপাতা দিয়ে মোট পাঁচ ধরনের পাখা তৈরি করেন তারা। এগুলো হলো—ডাটা পাখা, হাতল পাখা, ঘুরকি পাখা, পকেট পাখা ও আমান পাখা। এর মধ্যে প্রতি পিস হাতল পাখা পাইকারি বিক্রি করা হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায় এবং পকেট পাখা বিক্রি করা হয়
১৬ থেকে ২০ টাকায়। যোগীরভবন গ্রামের ঘরে ঘরে এখন তালপাখা তৈরির কর্মযজ্ঞ চলছে। কারিগরদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। গ্রামের প্রবীণ কারিগর হুজুর আলী বলেন, যোগীরভবন গ্রামে শত বছরের পুরোনো মন্দির আছে। আগে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এ মন্দিরে পূজা-অর্চনা করতে আসতেন। মন্দিরে আসা ভক্তদের জন্য হিন্দু কারিগরেরা হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। পরে অন্য ধর্মের মানুষও এটাকে পেশা হিসেবে নেন,
আশপাশের গ্রামেও তালপাখা তৈরি শুরু হয়। কাহালুর হাতপাখা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বৈশাখী মেলায় যায় এখানকার কারিগরদের বানানো পাখা। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরা আসেন পাখা নিতে। আবার অনেকে কারিগরদের আগাম টাকা দিয়ে পাখা তৈরি করিয়ে নেন। পাইকর ইউনিয়নের ইউনুস নামের এক কারিগর জানান, বগুড়া ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে পৌষ মাসের শুরুতে তালপাতা কিনে আনেন তারা। প্রতিটি পাতা ডাগুরসহ কিনতে খরচ পড়ে পাঁচ থেকে দশ টাকা। এরপর সতর্কতার সঙ্গে এই ডাগরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কাটতে হয়। এরপর পানিতে ভিজিয়ে কয়েকদিন রোদে শুকাতে হয়। রোদে শুকানোর পর গুচ্ছ হয়ে থাকা পাতাগুলো বাঁশের কাঁটির মাধ্যমে প্রসারিত করা হয়। এরপর গোলাকার পাতাটি রঙ করে বাঁশের খিল দিয়ে দুপাশ আটকিয়ে সেলাই করা হয়। তিনি আরও জানান, সবমিলিয়ে প্রতিটি রঙিন পাখা তৈরি করতে তাদের ১০ টাকা খরচ হয়। এরপর প্রতি পিস পাখা ১৬ থেকে ২০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করেন। দিনে একেকজন ১৫০টি পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারে।
নারী কারিগর শেফালি জানান, পুরুষরা শুধু পাতা নিয়ে এসে পানিতে ভিজিয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে দেয়। এরপর সেগুলোকে রঙিন সুই-সুতা দিয়ে সেলাই করে পাখার সম্পূর্ণ রূপ তারাই দেন। বৃষ্টি নামের আরেক কারিগর জানেন তিনি সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তালপাতার পাখা তৈরি করে থাকেন। তিনি দিনে ১০০ পাখা তৈরি করেন। এক পিস পাখা তৈরি করে তিনি পান ৪ টাকা। দিনে তিনি ৪শ টাকার পাখা তৈরি করেন। এই টাকা তার সংসারের কাজের লাগাতে পারেন।
Check Also
দুপচাঁচিয়ায় মাদ্রাসার সুপারকে মারপিট করে চাঁদা দাবীর প্রতিবাদে শিক্ষক-কর্মচারী পরিবার কল্যান সংস্থার মানববন্ধন
বগুড়া সংবাদ : দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল ইউনিয়নের জোহাল মাটাই ও টেমা দাখিল মাদ্রাসার সুপার আবুল …