
বগুড়া সংবাদ : দেশ বরেণ্য কবি, নজরুল গবেষক, প্রাবন্ধিক ও পাঠকপ্রিয় দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার বলেছেন, জুলাই বিপ্লবের পর দেশে তো সকাল হয়েছে, এখন তো ভোর, সকল অভিশাপ কেটে গেছে জাতির কপাল থেকে। আশা করি জুলাই বিপ্লব উত্তর আগামী দিনের সাংবাদিকতা বিষাক্ত, দূষিত, কুৎসিত হবেনা ইনশাআল্লাহ। তিনি শনিবার দুপুরে বগুড়া শহরতলির ছিলিমপুরে চার তারকা হোটেল নাজ গার্ডেনে ঐতিহ্যবাহী বগুড়া প্রেসক্লাবের নব-নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব আশা করেন।
বগুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রেজাউল হাসান রানুর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কালাম আজাদের সঞ্চালনায় অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি.এম. ইমরুল কায়েস, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া ও ট্রাফিক) আতোয়ার রহমান, দৈনিক করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু, দিনকালের বিশেষ প্রতিনিধি, আমরা জিয়া পরিবারের সদস্য’র আহবায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন, বগুড়া অ্যাডভোকেটস বার সমিতির সভাপতি আতাউর রহমান মুক্তা, জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি মোশারফ হোসেন, সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম, প্রেসক্লাবের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন, প্রেসক্লাবের সভাপতি রেজাউল হাসান রানু।
প্রধান অতিথি কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, সাংবাদিকদের বলা হতো সমাজের আয়না; আয়না আপনাকে দেখিয়ে দেয়। চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় সংবাদপত্রকে। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আরেকটি স্তম্ভ হলো সাংবাদিকতা। এ চতুর্থ স্তম্ভকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, আমরা যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছি তারা এক বা দুই টার্ম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। কিন্তু গ্যালারিতে যারা বসে আছেন, তারা আমৃত্যু দেশের প্রেসিডেন্ট থাকবে। কারণ তারা রাষ্ট্রকে পরিচালনায় সঠিক ভূমিকা পালন করেন। আমরা ভুল করলে তারা তা দেখিয়ে দেন। তাই সাংবাদিকের স্থান অনেক উঁচুতে।
বিগত কয়েক বছরে সাংবাদিকরা পঁচে গেছেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি পালাতে গিয়ে বর্ডারে ধরা পড়েছেন, প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তন হলে সাংবাদিক কেন পালাবে? অনেক সাংবাদিক আছে যাদের পাবলিক পিটিয়ে পুলিশে দিয়েছে। এমন সাংবাদিকতা পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবেনা। বাংলাদেশ ‘হাসু’ মিডিয়ায় পরিণত হয়েছিল। আমরা সে অবস্থা থেকে উদ্ধার পেয়েছি জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে।
প্রধান অতিথি গত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বগুড়ায় জুলাই আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৭ জন ছেলেমেয়ের নেতৃত্বে। তেমনি বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে ১৭ অশ^ারোহী বাংলা জয় করেছিলেন। এখানে ইতিহাসের মিল রয়েছে। বগুড়ায় যারা আত্মত্যাগ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের সবার প্রতি এবং ফ্যাসিজম বিরোধি আন্দোলনে গত ১৬/১৭ বছর যারা অমানুষিক কষ্ট ভোগ করেছেন, গুমের শিকার হয়েছেন, খুনের শিকার হয়েছে, মামলায় মামলায় জর্জরিত হয়েছেন, নাস্তানাবুদ হয়েছেন, তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রইল।
তিনি বলেন, এ বাংলাদেশ হতোই না যদি শহীদ জিয়াউর রহমান জন্ম না হতো। বগুড়ার মাটি শহীদ জিয়ার ঘাঁটি। শহীদ জিয়া যদি শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন আর কিছুই না করতেন তবুও তিনি ইতিহাসে আজকের যে মর্যাদায় আছেন, সেখানেই থাকতেন। কারণ হলো স্বাধীনতার দূর্যোগের সময় নিজের পরিবার-পরিজন অরক্ষিত রেখে সোজা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, যা ইতিহাসের দ্বিতীয় নজীর নেই।
শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, তাজউদ্দিন সাহেব তার ডায়েরিতে লিখেছেন তিনি ২৫ মার্চ রাত ৯-১০টার দিকে টেপ রেকর্ডার নিয়ে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বলেছিলেন। তখন মুজিব বলেছিলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ওরা (পাক শাসক) আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করবে। আর ঘোষণায় স্বাক্ষর দিলে আমার জন্য বিপদ হবে। যিনি (মুজিব) ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কান্ডারী হবেন তার এমন কাপুরুষতা কি মানায়?
অথচ শহীদ জিয়া বললেন, আমি বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। জিয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতেন তাই পরবর্তীতে বললেন, আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। এটা জিয়ার মহত্ব, না করলেও কোন সমস্যা ছিলনা। এবং সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দেন।
জিয়াউর রহমানের আদর্শের বৈশিষ্ট্যের মহত্বের আারেকটি দিক হলো তিনি ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলেন। যদি জিয়াউর রহমান সেদিন না থাকতেন তাহলে অনিবার্য গৃহযুদ্ধ হতো। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের নায়ক শহীদ জিয়া। এমন বিপ্লব ১৮৫৭ সালে হয়েছিল দিল্লীতে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামে। আর দ্বিতীয়বার হয়েছিল শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশে।
প্রধান অতিথি কবি আবদুল হাই শিকদার আরো বলেন, গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে আর কত গ্রাম তারপর বাগবাড়ি নাম আমার হৃদয়ে অবিরাম। বাগাবাড়ির মত গ্রাম আর একটাও নেই। বিএনপির সহজসরল মানুষের জন্য বগুড়ার গাবতলীর বাগবাড়ি তীর্থ কেন্দ্র হতে পারে। কারণ এটা স্বাধীনতার পূণ্যভূমি। স্বাধীনতার ঘোষক ও ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নায়ক রাষ্ট্রের জন্মদাতা বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র অবলম্বন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী জিয়া বাগবাড়ির সন্তান।
তিনি আরো বলেন, বগুড়ায় যতবার আসি হযরত শাহ সুলতান বলখী মাহীসাওয়ারকে সালাম দেই। বগুড়া মানে তারেক রহমান। তিনি (তারেক রহমান) বিবিসির সাথে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, এমন সাক্ষাৎকার গত ২০ বছরে কোথাও শোনা যায়নি। এমন ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার পরিণত, সংযমী, দৃষ্টান্তমমূলক রাষ্টনায়োকচিত, সাক্ষাৎকার। যেখানে একটি আপত্তিকর শব্দ নেই। অথচ তিনি পুরো বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন।
জিয়াউর রহমান সাংবাদিকদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তার দান করা জমিতে জাতীয় প্রেসক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। ভিত্তিস্থাপন করেছেন জিয়াউর রহমান। বগুড়া প্রেসক্লাবের ভবনের ভিত্তিপ্রস্তব স্থাপন করেছেন, তারেক রহমান। বগুড়া প্রেসক্লাবের বয়স ৬৫ বছর। ৬৫ বছরের ইতিহাস বাংলাদেশের কম প্রেসক্লাবের আছে। সে ক্লাবের ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তারেক রহমান। জিয়াউর রহমান প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রেস কাউন্সিল, প্রেস সংক্রান্ত সবকিছুই করেছেন।
তিনি বলেন, আরেকটা কথা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোন সংবাদপত্রে খারাপ কথা লেখা থাকে আমার খুব খারাপ লাগে। কারণ এটা অকৃতজ্ঞতার চুড়ান্ত নিদর্শন। কেন অকৃতজ্ঞতা এর কারণ শেখ মুজিবের শাসনামলে ২৭ হাজার মানুষ বিনা বিচারে নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক ভিন্নমত অবলম্বন করায় লাল, নীল বাহিনী বাহিনী, রক্ষী বাহিনী দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিবের শাননামলে ব্যাপক লুণ্ঠনের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে দেশের ১৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অথচ খাবারের কোথায়ও কোন ঘাটতি ছিলনা। অমর্ত সেন তার কাহিনীতে লিখেছেন, খাবারের কোন সংকট ছিলনা। ভারতে পাচার হয়ে যেত। গাইবান্ধার মানুষের বমি, কুকুরে মল খেতে দেখেছি। এমন বাংলাদেশ শেখ মুজিব উপহার দিয়েছিলেন।
মুজিব সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। চারটি বাদ দিয়ে সমস্ত সংবাদপত্র ব্যান্ড করেছিলেন। সাংবাদিকরা রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে খেয়েছেন। বায়তুল মোকারমের সামনে কাঁচের চুড়ি বিক্রি করেছেন। শহীদ জিয়া এ অবস্থা থেকে সাংবাদিকদের রক্ষা করেছিলেন। তিনি সংবাদপত্রের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। সে জন্য সাংবাদপত্রের শহীদ জিয়ার কাছে অনেক ঋণ আছে। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি না হলে বাংলাদেশের সংবাদপত্র মুক্ত হতো। সে মানুষটা না হলে আজ বুক ফুলিয়ে কথা বলতে পারতেন না। সাংবাদপত্র থাকতো না। আর সেই সংবাদপত্রে যখন শহীদ জিয়া সম্পর্কে কটুকথা বলেন, তখন খুব লজ্জা লাগে। কি পরিমাণ অকৃতজ্ঞ, কি পরিমাণ মূর্খ, জানেনা তার পিতার নাম কি? জানেনা কার জন্য এ সুন্দর দেশ পেয়েছেন।
যাই হোক হাসিনার আমলে ৭০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। দুই হাজারের মত সাংবাদিকদের হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিচার দূরের কথা একটি ঘটনার নুন্যতম তদন্ত করা হয়নি। শতশত সাংবাদপত্র, অনলাইন, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, আমারদেশ, দিনকাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মইনুল ইসলামের মত বিখ্যাত সাংবাদিক, সংসদে বাকশালের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তাকে কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে গেছে মিথ্যা কেসে। মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানের মত বয়োজোষ্ঠ্য অনেক সাংবাদিকদের জেলখানায় বেঁধে ফেলে রেখেছেন। এ বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, শেখ হাসিনা।
যা হবার হয়ে গেছে, এখন সাংবাদিকদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে ঝকঝকে ক্রিষ্টাল ক্লিয়ার করবো। দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে। সাংবাদিক নানা প্রশ্নে জর্জরিত। অসাধুতা, ব্ল্যাকমেইলিং, ফ্যাসিস্ট আমলের ধারাবাহিকতা এখনও আছে। মানুষের মন থেকে এসব দূর করতে সংবাদপত্রের সাথে জড়িতদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সংবাদপত্র সত্য প্রকাশের আয়নায় পরিণত করতে হবে। যে আয়না তারা নিজেদের চেহারা দেখতে পারেন। শাসকরা তাদের চেহারা দেখতে পারেন। সেই জায়গায় আমাদের সংবাদপত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আমাদের জুলাই বিপ্লব যেমন প্রাণবন্ত ও স্বার্থক হবে, শহীদ জিয়ার সংবাদপত্রকে মুক্ত করে দেওয়ার যে অসীম ভালোবাসা থেকে কাজটা করেছিলেন সেটাও সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। আগামী দিনের বাংলাদেশের কান্ডারী তারেক রহমানের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করুন, ৩১ দফা পড়ে দেখেন।
প্রশাসনকে বলেন, আপনারা সাংবাদিকদের ভালো নজরে দেখবেন। আপনারা যারা ভালের মানুষ আছেন তাদের হেল্প করবেন। তারা আপনাদের প্রতিপক্ষ নয়; সাংবাদিকতা, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। এ সহযোগিতা মনোভাব থাকলে সকলে ভালো থাকবেন। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কসাইখানা থেকে বের হয়ে এসেছে। এখন কেন আমাদের মধ্যে কোন সুসম্পর্ক থাকবে না?